ঈদের ছুটিতেও রেলকর্মীরা বঞ্চিত: রাষ্ট্রের বৈষম্য কি পেশাভিত্তিক নাকি ইচ্ছাকৃত
মনিরুজ্জামান মনির
০৫ জুন, ২০২৫, 3:59 PM

মনিরুজ্জামান মনির
০৫ জুন, ২০২৫, 3:59 PM

ঈদের ছুটিতেও রেলকর্মীরা বঞ্চিত: রাষ্ট্রের বৈষম্য কি পেশাভিত্তিক নাকি ইচ্ছাকৃত
২০২৫ সালের পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে সরকার ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে, যা দেশের সকল সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য। এর ফলে বিচার বিভাগ, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ শতাধিক সরকারি দপ্তরের কর্মচারীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারছেন।
কিন্তু একটি ব্যতিক্রম—বাংলাদেশ রেলওয়ে।এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮৯% কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা মূলত অপারেশনাল কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, তারা সরকারের ঘোষিত এই ছুটি উপভোগ করতে পারেন না।এমনকি সেই অতি জরুরি দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো অতিরিক্ত সম্মানী, বিকল্প ছুটি বা ভাতা দেওয়া হয় না।এটি কেবল অবিচার নয়—রাষ্ট্রীয় শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যের একটি নিষ্ঠুর চিত্র।
ঈদের দিনেও ডিউটি: কারা এই ‘অদৃশ্য বীর’?
ঈদে লাখ লাখ মানুষ ট্রেনে করে বাড়ি ফেরে। কিন্তু সেই রেল সিস্টেমকে সচল রাখতে যারা ঈদের দিনেও দায়িত্ব পালন করেন, তারা হলেন:লোকোমাস্টার, গার্ড, স্টেশন মাস্টার, বুকিং সহকারী,পোর্টার, ওয়েটিং রুম বেয়ারা, পি’ম্যান, ইয়াড ফোরম্যান, কেবিন ম্যান,ওয়েম্যান, কিম্যান, মিস্ত্রি, সিগনাল খালাসি, ইলেকট্রিক খালাসি,লোকো খালাসি, ক্যারেজ খালাসি, চৌকিদার, গেইট কিপার,নিরাপত্তা বাহিনী, টিটিই, টিসি, এটেনডেন্ট, টি এক্স আর, টিএনএল, ডিটিএনএল প্রমুখ।
তাঁদের ছুটি নেই, কিন্তু দায়িত্ব আছে।তাঁদের পরিবারে ঈদের আনন্দ নেই, কিন্তু রেলসেবা সচল আছে।তাঁদের শ্রমের কোনো অতিরিক্ত মূল্য নেই, শুধু আছে রাষ্ট্রের চরম অবহেলা।
রেলকর্মীরা কি শুধু ছুটির দিনেই বঞ্চিত?
না! বঞ্চনার তালিকা দীর্ঘ, এবং তা নানামাত্রিক।বাংলাদেশ রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা বহু দশক ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে ধাপে ধাপে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো:
১. চিকিৎসা সুবিধা হ্রাস:
রেলওয়ের কর্মচারী এবং তাঁদের পরিবার—যারা একটি বিশেষায়িত কারিগরি পেশাজীবী হিসেবে বিবেচিত—তারা আগে রেলওয়ে হাসপাতাল ও ডিসপেনসারিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা পেতেন। এখন সেই চিকিৎসা ব্যবস্থার বাজেট সংকোচিত, ওষুধের সংকট, জনবল সংকট, এবং বহিরাগত নিয়ন্ত্রণে বহু সমস্যা তৈরি হয়েছে।
২. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সুবিধা সংকুচিত:
রেলওয়ের নিজস্ব স্কুল, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একসময় রেল পরিবারের সন্তানদের জন্য ছিল প্রেরণার কেন্দ্র। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন আর মনোযোগ নেই; অনেক প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে অকার্যকর।
৩. আবাসন সুবিধা অবনতি:
পুরনো কলোনিগুলো জরাজীর্ণ, নতুন আবাসন প্রকল্পগুলো অপ্রতুল এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও সুরক্ষার বেহাল অবস্থা। বরাদ্দের স্বচ্ছতা নেই, এবং বেসরকারিকরণ চেষ্টায় অনেক অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত।
৪. পোষ্য কোটায় নিয়োগে বৈষম্য:
একসময় পিতা-মাতার স্থলে সন্তানদের নিয়োগে একটি সুবিন্যস্ত পোষ্য কোটা ছিল। এখন সেই কোটা প্রায় অকার্যকর—বিধি আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই।
৫. সাপ্তাহিক ছুটির বঞ্চনা:
অপারেশনাল শাখার কর্মচারীরা সাপ্তাহিক ছুটি থেকে বঞ্চিত। ৩০ দিন টানা কাজ করেও কোন মাসে একদিনও পূর্ণ বিশ্রাম পান না।
৬. ভ্রমণের জন্য পাস সুবিধা সংকোচন:
আগে পরিবারসহ নির্দিষ্ট দূরত্বে রেলপথে যাতায়াতের পাস সুবিধা ছিল। বর্তমানে সেটাও কাগজে কলমে সীমিত, বাস্তবে দুর্নীতিপূর্ণ এবং জটিল।
৪. কারা এই বৈষম্যের দায়ী?
রেলওয়ের নিজস্ব কিছু কর্মকর্তা ও আমলারা, যারা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়হীনভাবে কাজ করেন, তারাই একাধিকবার রেলওয়ে কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা সংকোচনের নীতিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন।
তাদের চিন্তা—রেলকর্মীদের প্রতি বাড়তি সহানুভূতি “অপ্রয়োজনীয় ব্যয়”, অথচ নিজেরা প্রমোশন, ভাতা, বিদেশ ভ্রমণ ও সেমিনার চুক্তির অপব্যবহারে এক নম্বর।
৫. ট্রেড ইউনিয়ন: পেশাজীবী সংগঠন নাকি রাজনৈতিক এজেন্ট?
রেলওয়ের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্বিশেষ রাজনৈতিক মেরুকরণে সম্পৃক্ত।
তাঁদের দায়িত্ব ছিল—
• রেল কর্মীদের অধিকার রক্ষা করা,
• পোষ্য কোটা কার্যকর রাখা,
• ছুটি ও সুযোগ-সুবিধা আদায় করা।
কিন্তু বাস্তবে তারা:
• কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত,
• অফিসারদের সঙ্গে আপস করে নিজেদের দলীয় কর্মীদের সুযোগ সুবিধা আদায় সময় পার করে অথচ কর্মচারীদের সমষ্টিগত স্বার্থে এক হয়ে একবারও রেল ভবনে অবস্থান করেননি,
• ছুটি, চিকিৎসা বা আবাসনের মতো ইস্যুতে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেননি।
ফলে রেলকর্মীরা আজ রাষ্ট্রের দ্বারেও ন্যায্যতার দাবি জানাতে বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত।
করণীয়: রেলকর্মীদের জন্য সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রয়োজন
এই বৈষম্য নিরসনে এখন সময় এসেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে রেলওয়ে কর্মীদের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়নের। এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত:
✅ ১. ঈদের দিনে দায়িত্বপালনকারীদের জন্য:
• বিকল্প ছুটি চালু
• বিশেষ উৎসবকালীন ভাতা চালু
✅ ২. পোষ্য কোটার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা
✅ ৩. রেলওয়ে হাসপাতালে পূর্ণ সুবিধা পুনর্বহাল
✅ ৪. আবাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কার
✅ ৫. ট্রেড ইউনিয়ন আইন সংস্কার করে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বাধ্যতামূলক করা
রেল সেবা চলুক, কিন্তু রেলকর্মীরা বঞ্চিত কেন?
রাষ্ট্র যখন এক হাতে ছুটি দেয়, অপর হাতে যদি নির্দিষ্ট একটি পেশাকে ছুটি থেকে বঞ্চিত করে—তাহলে সেটা আর নীতি নয়, সেটা বৈষম্য।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মচারীরা ঈদের ছুটির দিনে শুধু ট্রেন চালান না, তারা রাষ্ট্রের সেবাকে জীবিত রাখেন।
তাদের প্রতি এই অবিচার বন্ধ করতে হলে, কেবল সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়—দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, ট্রেড ইউনিয়নের জবাবদিহিতা এবং অধিকার রক্ষায় গণচেতনার উত্থান প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি - বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি
বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক সকালের সময়