প্রতারণা-জালিয়াতি করে ভূমিদস্যু ও ভূমিলিপ্সুদের জমি বেদখল ঠেকাতে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের যে কোনো জমি বেদখলের শাস্তি হিসেবে আইনে জেল ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় দেশের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে 'ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন-২০২১' এর খসড়া তৈরি করেছে।
খসড়া আইনে ব্যক্তি মালিকানাধীন, সরকারি খাস, সরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মালিকানাধীন জমি, ধর্মীয় বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জমি বেদখলের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নদী, হাওর, বিল ও অন্যান্য জলাভূমির শ্রেণি পরিবর্তন ও আবাসন কোম্পানি কর্তৃক জমি, ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অপরাধে দণ্ডের বিধানের কথা বলা হয়েছে। প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জমি বেদখল ঠেকানোর বিষয়টিতে।
চূড়ান্ত অনুমোদনের সুপারিশ করে আগামী কিছুদিনের মধ্যে এ খসড়া আইন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। সেখানে এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো বিষয়ে পর্যবেক্ষণ থাকলে খসড়াটি আবারও ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। কোনো পর্যবেক্ষণ না থাকলে আইন হিসেবে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এটিকে জাতীয় সংসদে পাঠানো হবে।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, আইনটি প্রণয়ন হলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অন্যায়ভাবে জমি বেদখলের ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। খাস জমি উদ্ধার করা যাবে। খাস জমির দখলকারীদের মোবাইল কোর্টের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। এ ছাড়া এই আইনের আওতায় জনগণ নানা ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
ভূমিমন্ত্রী বলেন, কারও মুখের দিকে তাকিয়ে খাস জমি উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হবে না। জমি যার দখলেই থাকুক না কেন সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারে যা যা করা দরকার তা করা হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ কুমার দাস বলেন, বিদ্যমান মোবাইল কোর্ট আইনে খাস জমি দখলকারীর শাস্তির বিধান নেই। ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের খসড়ায় মোবাইল কোর্টের জন্য নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। আইনটি হলে খাস জমি উদ্ধার ও দখলকারীদের জেল-জরিমানা নিশ্চিত করা যাবে।
খসড়া আইনে বলা হয়, ভূমিলিপ্সু বিভিন্ন ব্যক্তি জালিয়াতি বা প্রতারণা করে অন্যের সঙ্গে যোগসাজশে ভুয়া দলিল তৈরি করে বা দলিল ছাড়াই ব্যক্তি মালিকানাধীন বা সরকারি খাস জমিসহ সরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মালিকানাধীন জমি বেদখল করছে। এ জন্য পেশিশক্তি, আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। দেশের ভূমিতে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করতে এবং এসব অপরাধের প্রতিরোধ ও দ্রুত প্রতিকারে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
খসড়া আইনটিতে চারটি অধ্যায়, ৫০টি ধারা ও শতাধিক উপধারা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আইনের প্রারম্ভিক কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে অপরাধ ও দণ্ড, তৃতীয় অধ্যায়ে বিচার ও চতুর্থ অধ্যায়ে বিবিধ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।
খসড়া আইনে অপরাধ সংক্রান্ত ধারাগুলোর মধ্যে রয়েছে- অন্যের জমির মালিক হওয়ার লক্ষ্যে জাল দলিল সৃষ্টি, মালিকানার অতিরিক্ত জমির দলিল সম্পাদন, মালিকানার অতিরিক্ত জমি লিখে নেওয়া, পূর্ব বিক্রি বা হস্তান্তর গোপন করে কোনো জমি বিক্রি, বায়নাকৃত জমি পুনরায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া, ভুল বুঝিয়ে দানপত্র ইত্যাদি তৈরি, সহ-উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে প্রাপ্যতার বেশি জমির দলিল নিজের নামে তৈরি, সহ-উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে নিজের প্রাপ্যতার বেশি জমি বিক্রি, অবৈধ দখল ইত্যাদি, সহ-উত্তরাধিকারীর জমি জোর করে দখলে রাখা, অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ইত্যাদি, জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, বিনা অনুমতিতে জমির ওপরের কর্তন, অধিগ্রহণের আগে জমির মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত মূল্যে দলিল নিবন্ধন, জনসাধারণের ব্যবহার্য, ধর্মীয় বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জমি দখল, বিনা অনুমতিতে পাহাড় বা টিলার পাদদেশে বসতি স্থাপন, রিয়েল এস্টেট কর্তৃৃক জমি, ফ্ল্যাট হস্তান্তর ইত্যাদি।
কোনো জমির মালিকের সঙ্গে কোনো ডেভেলপার কোম্পানি রিয়েল এস্টেট প্রকল্প উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাস্তবায়ন যথাযথভাবে সম্পন্ন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমির মালিকের অংশ জমির মালিকের অনুকূলে হস্তান্তর না করলে কিংবা দখল বুঝিয়ে না দিলে অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাদণ্ড অথবা ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
যদি কোনো রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একটি জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে দলিল সম্পাদন করে, চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রাপ্তির পর ঘোষিত সময়ের মধ্যে জমির দখল হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হন, ফ্ল্যাট বিক্রির পর ঘোষিত সময়ের মধ্যে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা না হয়, ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হলেও দলিল হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হয়- তাহলে অনধিক দুই বছরের তবে অনূ্যন ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অপরাধের আরও বেশ কয়েকটি ধারা রয়েছে এ আইনের খসড়ায়। রয়েছে অপরাধের বিচারের বিভিন্ন ধারা।