ঢাকা ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম
আরও তেল-গ্যাস না কিনলে ইইউ’র ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি ট্রাম্পের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টি হতে পারে ঢাকা ও উপকূলে টঙ্গীতে বেইলি ব্রিজ ভেঙে নদীতে ট্রাক, বিকল্প পথে চলার অনুরোধ সচিবালয়ে উপদেষ্টা হাসান আরিফের জানাজা দুপুরে জাকের-শামীমকে ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ পুরস্কার দেওয়ার সুপারিশ বিশপের সাভারে চলন্তবাসে ডাকাতি, ছুরিকাঘাতে আহত ৪ ভোরের আগুনে পুড়লো বনানী বস্তির ঘর এক্সপ্রেসওয়েতে টোল ছাড়, সেনানিবাস হয়ে যেতে পারবেন বিমানযাত্রীরা সরাসরি পাকিস্তান থেকে ফের চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে জাহাজ ব্যবসায়ীরা খুব শক্তিশালী, সেটা ভাঙা সহজ না : অর্থ উপদেষ্টা

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে বাধা মোদির রাজনীতি

#

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

২৩ আগস্ট, ২০২৪,  4:17 PM

news image

১০ বছর আগে নরেন্দ্র মোদি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের নেতারাও ছিলেন।

আর এই বিষয়টি তার ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশী প্রথম’ বৈদেশিক নীতিকেই প্রতিফলিত করেছিল। সেসময় এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে নয়াদিল্লির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সমন্বয় গড়ে তোলা।

তবে সীমান্ত বিরোধ এবং দ্বিপাক্ষিক মতানৈক্য, ভারতের পক্ষ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বিলম্বিত সম্পাদন এবং এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে মোদির সেই বৈদেশিক নীতিটি খুব শিগগিরই ব্যর্থ হয়ে যায়।

অবশ্য এই নীতির অধীনে বাংলাদেশকে ভারতের উজ্জ্বল সাফল্য হিসেবে দেখা হয়েছিল। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা — যিনি এই মাসে চাপের মুখে পদত্যাগ করার আগে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন — মোদির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন; তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উভয় দেশের জন্য লাভজনক পরিস্থিতি বলে মনে হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ভাবে ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও পরবর্তীতে হাসিনা একজন কর্তৃত্ববাদী শাসকে রূপান্তরিত হন। তার বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে; আর সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছিল সেই ক্ষোভের চূড়ান্ত ট্রিগার। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে হাসিনা গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।

বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে হাসিনার দারুণ অজনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার এই পদত্যাগ ভারতীয় রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংস্থার জন্য বড় একটি ধাক্কা হিসাবে সামনে এসেছে। ভারত তার শাসনামলে হাসিনাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে গেছে, আর সেটিও আবার অন্যান্য স্টেকহোল্ডার এবং বাংলাদেশের জনগণের উদ্বেগ উপেক্ষা করে। নরেন্দ্র মোদির অধীনে নয়াদিল্লি তার বেশিরভাগ প্রতিবেশী দেশের সাথে এই নীতি ও পদ্ধতিই গ্রহণ করেছে। আর এর ফলে কখনও কখনও দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে ভারতকে।

এটা স্পষ্ট যে, নিজের প্রতিবেশী দেশে ভারতের এই নীতিগত ব্যর্থতা শুধুমাত্র বহিরাগত ঘটনার কারণে নয়। এগুলো ভারতের বর্তমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরও বহিঃপ্রকাশ। কূটনীতির নিরাপত্তাকরণ থেকে শুরু করে মোদির শক্তিশালী ভাবমূর্তি, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মধ্যে নিজের উদারপন্থি পরিচয়কেও ক্ষুণ্ন করেছে নয়াদিল্লি। মোদির পছন্দসই কর্পোরেট স্বার্থের জন্য হাসিনার মতো সরকারগুলোর সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক আচরণ নয়াদিল্লির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।

মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের আনুগত্য ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থ, বিশেষ করে বাংলাদেশে ক্ষতির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৯ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে (সিএএ) মুসলমানদের বাদ দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নির্যাতিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্য দ্রুত ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল এবং এটি বাংলাদেশি জনসাধারণের কাছ থেকেও সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমানদের প্রতি বিজেপি সরকারের অশোভন আচরণও বিদেশে মোদির সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালে মোদির বাংলাদেশ সফর দেশটিতে সহিংস দাঙ্গার সূচনা করেছিল।

হাসিনার পদত্যাগ ভারত সরকারের জন্য আত্মদর্শনের সুযোগ হয়ে সামনে এসেছে, কিন্তু এরপরও দেশটি তাদের নীতি সংশোধনে যুক্ত হতে পারেনি বলে মনে হয়। বাংলাদেশে ভারতের কলঙ্কিত ভাবমূর্তি দক্ষিণ এশিয়ায় মোদি সরকারের প্রথম বড় ব্যর্থতা নয় এবং এটি শেষ ব্যর্থতাও হবে না। প্রকৃত হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও সেই পথ অনুসরণ শুধুমাত্র ভারতের জন্যই ক্ষতিকর নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও নয়াদিল্লির ফলাফল হবে বিপর্যয়কর।

হাসিনার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর। তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর হাসিনা এবং তার বোন ভারতে আশ্রয় নেন। তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করার জন্য বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব নেওয়ার আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের পর থেকে হাসিনার শাসন কর্তৃত্ববাদী মোড় নেয়। মূলত সেসময় থেকেই তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক এবং অধিকার কর্মীদের ওপর নির্যাতন ও দমন-পীড়ন শুরু করেন।

হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর ওপরেও অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে; অবশ্য তার বিরোধীদের বিপরীতে তিনি ভারতবিরোধী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঘাঁটি স্থাপন করতে দেননি। ভারত অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে কেবল হাসিনাকেই সমর্থন করেছিল। আর এ কাজে ভারতীয় কর্মকর্তাদের যুক্তি ছিল, হাসিনা ক্ষমতা হারালে, ‘ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হবে’ বাংলাদেশ। এমনকি চলতি বছর বিতর্কিত ও বহুল সমালোচিত নির্বাচনে হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হওয়ার পর গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ নিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ বন্ধ করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের কাছে তদবিরও করেছিল ভারত।

হাসিনার সময়ে বাংলাদেশ ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছিল এবং সামরিক বাহিনীসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তিনি; ফলস্বরূপ ভারত ধরে নিয়েছিল, ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সত্ত্বেও হাসিনা তার শাসন চালিয়ে যাবেন। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতায় নয়াদিল্লি হতবাক হয়ে যায় যখন চলতি মাসের শুরুতে হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। বিশ্বের কোনও পশ্চিমা দেশই তাকে আশ্রয় দেয়নি, আর এতে করে নয়াদিল্লিতেই আটকে রয়েছেন হাসিনা। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার পর দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।

নয়াদিল্লি তার প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থা অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া করেছে, ফলে এই দেশগুলোতে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। আর এতে করে এই অঞ্চলে বৃহত্তর জনসাধারণের আবেগ-অনুভূতির বাইরে চলে গেছে ভারত। এমনকি এসব দেশে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণসহ রাজনৈতিক বিরোধীদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্কের মাধ্যমও নষ্ট করেছে নয়াদিল্লি।

এমনকি মিয়ানমারে ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ভারত। আর এর মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভকারীদের কার্যত পরিহার করেছে দেশটি। আফগানিস্তানে ভারত যদিও তালেবান শাসকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তারপরও সেটি তারা করেছে জাতীয়তাবাদী আফগানদের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে উপেক্ষা করে। বাংলাদেশে ভারতের নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি উভয় দেশের সীমান্তে প্রকাশ পেয়েছে; মূলত সীমান্তে বাংলাদেশিদের ওপর ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কঠোর আচরণের অভিযোগ রয়েছে প্রচুর।

মোদির কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতিকেও নতুন রূপ দিয়েছে। বিতর্কিত ভারত-চীন সীমান্তে চীনের অনুপ্রবেশের বিষয়ে মোদি নীরবতা বজায় রাখলেও, ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলো তার ভাবমূর্তি নির্মাণের চেষ্টায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ভারত ২০১৫ সালে মিয়ানমারে ভারতীয় বিদ্রোহীদের ট্রানজিট ক্যাম্পের বিরুদ্ধে আন্তঃসীমান্ত অভিযান শুরু করে, একই বছর দেশটি নেপালের ওপর বাণিজ্য অবরোধ জারি করে।

মূলত নেপাল সেসময় নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র বা দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আর গত বছর মোদির সমর্থকরা ভারতীয় পর্যটকদের মালদ্বীপ বয়কট করার জন্য প্রচারণা অভিযান শুরু করে। মালদ্বীপের কিছু মন্ত্রী মোদির সমালোচনা করেছিলেন বলে সংবাদ প্রকাশের পর সৃষ্ট কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের জেরে তারা মালদ্বীপ বয়কটের দাবি তোলেন।

অন্যদিকে ভারত সীমান্তে দেশটির কঠোর ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া, ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট সুবিধার পাশাপাশি বাণিজ্য-সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যাগুলোর বিষয়ে নয়াদিল্লির পদক্ষেপ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের অভিযোগ ও ক্ষোভ ছিল প্রচুর। যদিও এসব বিষয় ঢাকার কাছে অনুমিতই ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের জনসাধারণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভকে হাসিনার ওপর স্থানান্তরিত করেছে বলে মনে হচ্ছে।

ভারতের রাজনৈতিক বিরোধীরা নিয়মিত মোদির ঘনিষ্ঠ ফার্মগুলোকে সমর্থনের জন্য তার সমালোচনা করেছেন, বিশেষ করে ধনকুবের গৌতম আদানির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার বিষয়ে মোদি এসব সমালোচনার শিকার হয়েছেন। মোদির সঙ্গে কিছু প্রতিষ্ঠানের এই সম্পর্ক ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। গত বছর আদানি গ্রুপ পাওয়ার প্লান্ট বাংলাদেশে ১০০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে বলে ঘোষণা করার পর হাসিনার সাথে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন আদানি। আর এটি বাংলাদেশে সমালোচনার জন্ম দেয়। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, নিজের ‘রাজনৈতিক বৈধতা সুরক্ষিত করতে’ মোদির রাজনৈতিক অনুগ্রহ প্রয়োজন ছিল হাসিনার।

পপুলিজম, কর্তৃত্ববাদ এবং ক্রোনিজম বাংলাদেশে ভারতের সমস্যা সৃষ্টিতে অবদান রেখেছিল। কিন্তু মোদি সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনুসরণ নয়াদিল্লির জন্য আরও ক্ষতির কারণ হয়েছে।

২০১৯ সালে প্রণীত সিএএ শেষ পর্যন্ত ভারতকে একটি প্রকৃত হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যেই কাজ করেছে; যে সকল নির্যাতিত সম্প্রদায় ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য দ্রুত আবেদন করার সুযোগ পেয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের হিন্দুরাও। হাসিনার মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করায় বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।

এর ফলে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী আখ্যানের জন্ম হয়েছে, যেমনটি হয়েছে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের বিতর্কিত নানা বক্তৃতার কারণেও। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের উইপোকা, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে অভিহিত করেছেন।

অবশ্য বিতর্কিত সিএএ আইনের আগে, ভারতীয় বিচার বিভাগ বৈধ নাগরিকদের নাম নথিভুক্ত করার জন্য এবং আসাম রাজ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীদের চিহ্নিত করার জন্য কঠোর জরিপের নির্দেশ দিয়েছিল। সমালোচকরা অবশ্য এটিকে অনথিভুক্ত ভারতীয় মুসলমানদের টার্গেট করার একটি উপায় হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

এছাড়া অমিত শাহ এই জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) দেশব্যাপী কার্যকর করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন, কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও নয়াদিল্লি এই নথিভুক্তকরণকে একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেছে, তারপরও ভারতের ‘অবৈধ বিদেশি নাগরিক’ সমস্যার কেন্দ্রে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশও। অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করেছিলেন, সিএএ এবং এনআরসি লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমানকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

এদিকে হাসিনার সরকার তাদের নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই ধারণাকে শক্তিশালী করতে থাকে যে, তিনি (হাসিনা) নয়াদিল্লি থেকে পাওয়া বিভিন্ন আদেশ অনুযায়ীই কাজ করছেন। ২০২২ সালে বিজেপির একজন মুখপাত্র মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে অপমান করে বিতর্কিত মন্তব্য করলে সেটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষের মনে ক্রোধ সৃষ্টি করে; তবে হাসিনা সরকার সেসময় বিষয়টিকে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ বলে ঘোষণা করেছিল।

বাংলাদেশে এসব বিষয়ে নিয়ে একে একে অভিযোগ বাড়তে শুরু করে এবং ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি বিজেপি সরকারের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এই অভিযোগ কমাতে কোনও সাহায্য করেনি। চলতি বছর ভারতে নির্বাচনের প্রচারণার সময় মোদি ব্যাপকভাবে মুসলিম-বিদ্বেষী বক্তব্য-বিবৃতি দেন। এর আগে গত বছর তিনি দেশটির নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করেন যেখানে ‘অখণ্ড ভারতের’ একটি ম্যুরাল রয়েছে। আর সেই অখণ্ড ভারতের সীমানার মধ্যে ভারতের সমস্ত ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো রয়েছে বাংলাদেশও।

গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে দেওয়া নিজের জাতীয় ভাষণে মোদি ভারতের ১৪০ কোটি নাগরিকদের বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা বলেছিলেন। এটি ছিল ভারতকে শুধুমাত্র একটি হিন্দু আবাসভূমি হিসাবে দেখানোর পাতলা আবৃত উপায়। যদিও বহুজাতিগত, বহুধর্মীয় এবং বহুভাষিক দেশ হিসেবে ভারতের শত শত বছরের ইতিহাস রয়েছে।

এছাড়া সাম্প্রতিক অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দুদের হত্যার বিষয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর দায়ে বিজেপি সরকার তার কট্টর ডানপন্থি সমর্থকদের এবং মিডিয়াকে নিন্দা করতে অস্বীকার করে। যদিও ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নানা সময়ে প্রতিশোধমূলক বিভিন্ন হামলার ঘটনাও ঘটে থাকে।

মোদি সরকারের এখন আত্ম-প্রতিফলনের ক্ষমতা কম বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে হাসিনার পদত্যাগের পেছনে কারণ হিসেবে পাকিস্তান, চীন বা ইসলামপন্থিদের দোষারোপ করার পরিবর্তে ভারতকে স্বীকার করা উচিত, তার প্রতিবেশী দেশের নাগরিকরা এখন তাদের অধিকার বা কর্তৃত্ব ফিরে পেতে পারে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে তারা সেটি ব্যবহারও করতে পারে।

এছাড়া ভারতকে দূরবর্তী অঞ্চলে একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসাবে মনে করা হলেও দেশটিকে (ভারত) এখনও তার প্রতিবেশীদের শক্তিমত্তার কাছে তুলনামূলকভাবে দুর্বল শক্তি হিসাবে দেখা হয়। ভৌগলিক বাস্তবতা হচ্ছে, আশপাশের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোকে অবশ্যই ভারতের সাথে কাজ করতে হবে, কিন্তু এখন নতুন করে এসব দেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করাটা নির্ভর করছে নয়াদিল্লির ওপরই।

ফরেন পলিসিতে এই নিবন্ধটি লিখেছেন সুশান্ত সিং। তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটির লেকচারার এবং ভারতের ক্যারাভান ম্যাগাজিনের কনসাল্টিং এডিটর। তিনি আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ডেপুটি এডিটর ছিলেন এবং দুই দশক ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন।

logo
সম্পাদক ও প্রকাশক মো: মনিরুজ্জামান মনির