বাস্তব জীবনের গল্প! জনি তার মা-বাবাকে খুঁজে পেতে চায়!
নিজস্ব প্রতিবেদক
০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, 7:39 PM
নিজস্ব প্রতিবেদক
০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, 7:39 PM
বাস্তব জীবনের গল্প! জনি তার মা-বাবাকে খুঁজে পেতে চায়!
আশরাফুল হক, লালমনিরহাট
মানুষের বাস্তব জীবনের গল্প, আর কাল্পনিক কিছু গল্পের অংশ-বিশেষ আমরা দেখি বিভিন্ন সিনেমায়। তবে জনির জীবনের গল্পটা একেবারেই ভিন্ন। তার বাস্তব জীবনের এ গল্পে সৃষ্টিকর্তার নির্ধারণ করা চরিত্রে অভিনয় করতে করতে পাণ্ডুলিপির আগের পাতাগুলোয় কি লেখা ছিলো তা জানার বড় সাধ হয় এখন তার।বলছি-লালমনিরহাট শহরের বিডিআর হাটখোলা পাঁচ পীর মাজারের পাশের চা-বিস্কুটের দোকানী মোছাঃ জনি বেগমের (৩৪) কথা। তিনি খোচাবারি এলাকার অটো চালক আমির হোসেনের (৩৮) স্ত্রী।
জনি ছোটবেলায় হারিয়ে যায় তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে।জনির আবছা-আবছা মনে পরে, আর যে মা তাকে লালন-পালন করেছেন তার ভালো করেই মনে আছে যে, এক বৃদ্ধার হাত ধরে ৪/৫ বছরের জনি লালমনিরহাটে এসেছেন, সে বলেছিলো তাকে ঢাকার কমলাপুর/রংপুর রেল স্টেশন থেকে পাওয়া গেছে। নাটকিয় ভাবে কোন এক মহিলা ওই বৃদ্ধাকে বলেছিলো বাচ্চাটাকে একটু দেখবেন, পরে সে মহিলা আর ফিরে আসেনি। জনির বয়স তখন মাত্র ৪/৫ বছর। আবছা-আবছা মনে পরে গরম কালে ফ্রগ পড়ে মায়ের সাথে কোথাও যেন বেড়াতে যাচ্ছিলেন হয়তো। ফেলে যাওয়া মহিলাটি কে তা স্পষ্ঠ মনে নেই জনির। কয়েক ঘন্টা পড়ে জনিকে ফেলে যাওয়া মহিলা না আসায় ট্রেন ফেল করেন ওই বৃূদ্ধা যিনি জনিকে কমলাপুর শ্টেশন/রংপুর স্টেশন থেকে লালমনিরহাটে নিয়ে আসেন। বর্তমানে ওই মহিলা বেঁচে নেই, যিনি জনিকে এনেছিলেন।
সেই বৃদ্ধার পাশে জনিকে কাঁদতে দেখে স্টেশনে দায়িত্বে থাকা পুলিশেরা ওই বৃদ্ধার কাছে বিস্তারিত শুনে তার হাতে ২০০শত টাকা দিয়ে বলেছিলো আপনি বাচ্চাটাকে নিয়ে যান। অন্য কাউকে দিয়ে দেবেন, যাদের বাচ্চা হয়না, এমন কাউকে।এখান থেকেই শুরু হয় জনির জীবনের ছন্দপতন। ওই বৃদ্ধা (বুড়িমার) ছিলো অভাব অনটনের সংসার। জনিকে কিভাবে লালন-পালন করবেন ভাবনা তখন বুড়ি-মার।
ছোট জনিকে এনে প্রথমে দায়িত্ব নেয় লালমনিরহাট শহরের খোঁচাবাড়ি মাস্টার পড়ার ফয়জার হোসেন (৬০) নামের এক ব্যক্তি। সেখানে বেশি দিন থাকতে পারেনি ছোট জনি। বাঁদরামো করতো-গাছের ডালে-ডালে আর ঘুরে ফিরে কবরস্থানেই গিয়ে খেলাধুলা করতো, তাই তারা আবারো জনিকে নিয়ে আশে ওই বুড়িমা এবং তারি ছেলে আজিজার ও ছেলের বৌ রুবিনা জনিকে লালন-পালন করার ইচ্ছা পোষণ করেন। সেখানে মাস তিনেক থাকার পর স্হানীয় বিডিআর হাট পাঁচ পীরের মাজারের খাদেম, আলী আকবরের স্ত্রী হাসিনা বেগম (৬৫) জানতে পারেন প্রতিবেশী আজিজার ও রুবিনা দম্পতির ঘরে একটি মেয়ে আছে যা কিনা স্টেশনে কুড়িয়ে পাওয়া গেছে।
সে সময় ওই এলাকায় জনিকে নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তাই ওই মাজারের খাদেমের অনুমতি নিয়ে শিশু জনিকে দেখতে যান খাদেমের স্ত্রী হাসিনা বেগম।সেখানে গিয়ে দেখেন, শিশু জনি খেতে বসেছে। আজকের বৃদ্ধা হাসিনা বেওয়া তখন মধ্যবয়স্ক নারী। তাকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরেন জনি। কি যে দেখেছিলেন তার মাঝে তা আজও বলতে পারেননা কুড়িয়ে পাওয়া জনি। তবে অনেক শক্ত করেই ধরেছিল তাকে। অনেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলো। বাধ্য হয়ে একটি পালিত কন্যা থাকা সত্যেও বাড়িতে নিয়ে আসেন জনিকে। স্বামি মাজারের খাদেমের কাছে আকুতির ছলে বলতে থাকেন, "বাচ্চাটা ছাড়লোনা আমাকে। ওকে কিন্তু একেবারেই নিয়ে এসেছি। অনেক কান্না করেছিলো জনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামায় সে, তাই নিয়ে এলাম, তুমি কি বলো? বর্তমানে জনির আশ্রয় দাতা পালিত মা এ প্রতিবেদককে জানান, তার স্বামির বক্তব্য ছিলো অনেকটা এমন, আমাদের সন্তান নেই, আল্লাহর ইচ্ছাতেই এক মেয়েকে লালন-পালন করছি। ওর রিজিক যদি আমার ঘরে থাকে তাহলে কারোরি কিছু করার নেই। ও আমাদের কাছেই থাকবে।" তখন থেকে জনির বাবা নামের বটবৃক্ষ ঐ মাজারের খাদেম আলি আকবার যা জনির জাতীয় পরিচয় পত্রে লিখা আছে। তখন থেকে মমতাময়ী হাসিনা বেগমের মাতৃস্নেহে মাজার লাগোয়া বাড়িতেই জনির শুরু হয় বেড়ে ওঠা।
পড়ালেখাও শুরু হয় বাড়ির পাশেই তৎকালীন খোঁচাবারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।জনির বাল্যবন্ধুদের সাথে কথা বলে জানাযায়, ছোটবেলায় জনি সব সময় দুরন্তপনায় মেতে থাকতো। কেউ বলে সে প্রথম থেকেই ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতো আবার কেউ বলে রংপুরের ভাষায় কথা বলতো। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার বয়স বর্তমানে ৩৩ বছর। তিনি শিশুকাল থেকে আজ অবধি কথা বলে যাচ্ছেন ঢাকাইয়া ভাষাতেই। যাদের আশ্রয়ে ছিলেন জনি, তারা সকলেই বলছে জনির আচরণ আর কথাবার্তায় বোঝা যেতো সে ভালো কোনো পরিবারের মেয়ে। নানা জনের নানা ধারণা ও মন্তব্য রয়েছে। যেহেতু জনির মনে আছে সে কোনো এক স্টেশন থেকে হারিয়েছে, তাই অনেকে ধারণা করছেন, সে হয়তো মায়ের সাথেই ছিলো, হয় কমলাপুর স্টেশন নয়তো রংপুর স্টেশন থেকেই তার লালমনিরহাটে আসা।
জনির বিয়ে হয়েছে, দুই কন্যা সন্তানের জননী সে। বড় মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী আর ছোট মেয়ে ১ম শ্রেণীতে পড়ে।নিজে ছোট্ট চায়ের দোকান করে আর স্বামীর উপার্জিত অর্থে ভালোই কাটছে জনির সুখের সংসার। মাস খানেক আগে রংপুরের শ্যামপুর এলাকা থেকে এক পরিবার এসে দাবি করেন জনি তাদের মেয়ে। জনির আশ্রয় দাতা মা যিনি ৩০টি বছর বুকে আগলে রেখেছেন জনিকে তিনি তাতেই আহাজারি শুরু করেন। হাসিনা বেওয়া মনে করেন আমার মেয়েকে বুঝি নিয়ে যাবে। এক পর্যায়ে রংপুর থেকে আসা ঐ পরিবার জনির সাথে তাদের ডি-এন-এ টেষ্ট করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আর এরই মাঝে ঐ পরিবার লালমনিরহাট শহরেই খুঁজে পান তাদের হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে।সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আর জনিকে খুঁজতে আসার উসিলায় ওই পরিবার তাদের মেয়েকে ২৫ বছর পরে খুঁজে পেয়েছেন। ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করেছেন। নিমন্ত্রণও পেয়েছেন জনিসহ তার পরিবার।শিশু ও শৈশবে দুরন্ত ছিলো জনি। বর্তমানে দোকানের কাস্টমারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সদা হাস্যজ্জল মুখে কিছু দিন থেকে হাসি নেই, মলিন মুখে বসে সারাদিন দোকান ও সংসারের দেখভাল করেন জনি। এখন তার জানার বড় ইচ্ছা, আদৌ কি তার পরিবার ছিলো, মা-বাবা কে তার? কোন ভাই-বোন আছে কি তার? এমন প্রশ্নই প্রতি-নিয়ত তারা করছে জনিকে।
জনির বাস্তব জীবনের এ গল্পের পাণ্ডুলিপির প্রথম পাতাগুলোয় কি লিখা ছিলো তা জানতে চায় জনি।জনি বলেন, আমাকে খুঁজতে এসে দীর্ঘ ২৫ বছর পর .
জনি বলেন, আমাকে খুঁজতে এসে দীর্ঘ ২৫ বছর পর একটি পরিবার তাদের মেয়েকে খুঁজে পেয়েছে। আমিও আমার পরিবারকে খুঁজে পেতে চাই। আমি যখন হারিয়েছি তখন আমি ছোট ছিলাম। আমার না হয় কিছু মনে নেই, কিন্তু যারা আমাকে হারিয়েছে তাদের কারো না, কারো তো-মনে আছে। আমার বিশ্বাস আপনারা যদি আমাকে সহযোগীতা করেন তাহলে আমি আমার পরিবারকে ফিরে পাবো ইনশাল্লাহ।
আর ফেসবুক ইউটিউব সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জনি তার পরিবারকে ফিরে পাবে এমন প্রত্যাশা করছেন জনি ও তার পরিবার এবং প্রতিবেশীরা।
এবিষয়ে বর্তমানে জনির পালিত "মা" হাসিনা বেওয়া যিনি জনিকে ৩০ টি বছর বুকে আগলে লালন-পালন করেছেন তিনি জানান, জনিকে পাওয়ার সময় তার নাম বলেছিলো ফাতেমা। বাবা মায়ের নাম ঠিকানা কিছুই বলতে পারতোনা ৪/৫ বছরের জনি। তবে যে বৃদ্ধা (বুড়ি) ওকে নিয়ে এসেছে, সে বলেছিলো ঢাকা কমলাপুর স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিলো। আমার কোনো বাচ্চা না থাকায় আমি একটা মেয়েকে পালিত নিয়েছিলাম। পড়ে জনিকে পাওয়ার পর দু'জনকেই সমান ভাবে মায়ের স্নেহ-মমতা দিয়ে মানুষ করেছি। এখন আমারও ইচ্ছে হয় আমার জীবন দশায় যদি জনির পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যেত, তাহলে মরেও শান্তি পেতাম।