২০ হাজার কোটি টাকায় নতুন রিফাইনারি করছে বিপিসি
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ আগস্ট, ২০২২, 12:26 PM
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ আগস্ট, ২০২২, 12:26 PM
২০ হাজার কোটি টাকায় নতুন রিফাইনারি করছে বিপিসি
২০২০-২১ অর্থবছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। এমনকি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসানের তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। এসব লোকসান পোষাতে ও বিশ্ববাজারে জ্বালানি দাম বাড়ার কথা বলে ভোক্তাপর্যায়ে তেলের দাম বাড়িয়েছে তারা।
লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিনে এক লাফে ৩৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ টাকা ও পেট্রলে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। অথচ ‘লোকসানে’ থাকা বিপিসি ১৯ হাজার ৭৬৮ কোটি ৯৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে। প্রকল্পটির নাম ‘ইন্সটলেশন অব ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ইউনিট-২’। অনুমোদনের পর পাঁচ বছর মেয়াদে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বিপিসি ও ইআরএল। তবে বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যয়বহুল প্রকল্প নেয়া ঠিক হবে না বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
প্রকল্প নিয়ে বিপিসি বলছে, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রক্রিয়াকরণে ইআরএলের নতুন একটি ইউনিট (ইআরএল ইউনিট-২) স্থাপন করা হবে। যেখানে বিপিসির মাধ্যমে বছরে তিন মিলিয়ন মেট্রিকটন তেল পরিশোধন করা যাবে। এতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় হবে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানিনির্ভরতাও কমবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ (ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড) দিয়ে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পেট্রলিয়ামজাত পণ্যের চাহিদা পূরণ করা যাবে। এছাড়া সাশ্রয়ী উপায়ে অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে অধিক মূল্যের পেট্রলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হবে।
বিপিসি জানিয়েছে, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের চাহিদাপূরণ, পরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানিনির্ভরতা কমানো, জ্বালানি নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় করার জন্য বিপিসি প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রক্রিয়াকরণ করে তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ীমূল্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
সংস্থাটির দাবি, প্রকল্পের আওতায় তিন মিলিয়ন মেট্রিকটন ক্ষমতাসম্পন্ন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রক্রিয়াকরণে এ ইউনিটটি স্থাপন করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ইআরএলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিকটন থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিকটনে উন্নীত হবে।
প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের পেট্রলিয়াম পণ্য যেমন- গ্যাসোলিন, জেট ফুয়েল, ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও বিটুমিনের উৎপাদন বাড়বে। সেই সঙ্গে দেশের প্রেক্ষাপটে দুটি নতুন পণ্য লুব বেস অয়েল ও সালফার উৎপাদিত হবে। এ দুটি পণ্যের উৎপাদন দেশের সলিড সালফার ও লুব্রিকেন্টস পে আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করবে।
দেশের কৃষিখাত ও লুব্রিকেশন শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে প্রকল্পটি। দেশের গ্যাসোলিন ও জেট ফুয়েলের বর্তমান চাহিদা সম্পূর্ণরূপে মেটাতে সক্ষম হবে। উদ্বৃত্ত গ্যাসোলিন বিদেশে রপ্তানি করা হবে। বর্তমান রিফাইনারিটি প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো হওয়ায় এতে পরিশোধিত পেট্রলিয়ামজাত পণ্য বর্তমান সময়ের গুণগত মানে উন্নীত করা প্রয়োজন।
বিদ্যমান ইআরএল দেশের পেট্রলিয়ামজাত পণ্যের চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে। বাকি পণ্য আমদানি করতে হয়। এছাড়া ইউরো-৫ মানের পণ্য প্রবর্তনের ফলে পেট্রলিয়াম পণ্যের স্পেসিফিকেশন খুব কঠোর হয়ে উঠেছে।
তুলনামূলকভাবে উচ্চতর সালফারসামগ্রীর কারণে ইআরএলের গ্যাসোলিন এবং ডিজেল পণ্য ইউরো-৫ মানের নয়। প্রস্তাবিত রিফাইনারিতে (ইউনিট-২) প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ইউরো-৫ মানের গ্যাসোলিন ও ডিজেল উৎপাদন করবে বিপিসি। বর্তমান রিফাইনারির সঙ্গে স্থাপিত রিফাইনারির সমন্বয় করা হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে সাইট প্রিপারেশন, ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট, কনস্ট্রাকশনের (সিভিল ও মেকানিক্যাল) কাজ করা হবে। এজন্য পিডিবি হতে ইলেকট্রিক্যাল লাইন সংযোগ ও প্রকল্পের জন্য ন্যাচারাল গ্যাস লাইন সংযোগ দেওয়া হবে।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) খালিদ আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আমাদের ক্যাপাসিটি দ্বিগুণ হবে। ক্রুড অয়েল থেকে ডিজেল তৈরি করতে পারবো। তখন ডিজেলের দাম কমবে। খরচ কমে গেলে তখন জ্বালানি তেলের দামও কমবে।’
সংকটের মুহূর্তে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়ার যৌক্তিকতার বিষয়ে জানতে চাইলে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘প্রকল্পের টাকা আগেই ধরা আছে। আমাদের প্রজেক্টের টাকা আছে, সমস্যা হবে না।’
এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগে পাঠিয়েছে বিপিসি। প্রকল্পের ওপর আগামী ২৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হবে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) মোহাম্মদ এমদাদ উদ্দিন মিয়ান।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভার আগে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পের বিষয়ে বিশ্লেষণ ও মতামত তুলে ধরেছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে কিছু খাতে অযৌক্তিক ব্যয় খুঁজে পেয়েছে কমিশন।
কমিশন জানিয়েছে, প্রস্তাবিত ডিপিপির বর্ণনাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মোট ৬৪ দশমিক ১২৭ একর জমি (জেনারেল ইলেকট্রিক একর সরকারি খাস জমি) দীর্ঘমেয়াদি লিজ গ্রহণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান ইআরএল প্রাঙ্গণে ৫৯ একর খালি জমি ও লিজ নেওয়া ৬৪ দশমিক ১২৭ একর জমিসহ মোট ১২৩ দশমিক ১২৭ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
তবে প্রকল্পের ডিপিপিতে প্রাক্কলিত ব্যয়ের সারসংক্ষেপে শুধুমাত্র ৫০ একর জমি ভাড়ার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১২৩ দশমিক ১২৭ একর ভূমি এবং ৫০ একর ভূমির ব্যবহারসহ বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া দরকার। কিন্তু জমির মৌজা, দাগ, খতিয়ান, পরিমাণ প্রকল্পে উল্লেখ নেই। তাছাড়া লিজ নেওয়া ভূমির ভাড়া, নবায়ন ফি ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনাও নেই প্রকল্পে। এটা সংযুক্ত করা দরকার।
প্রকল্পের স্থাপনা নির্মাণের ব্যয় খাতে ৫০ কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যয় উপখাতের আওতায় ১৫টি আইটেমের বিস্তারিত খরচ বিভাজন দেওয়া হয়নি। বিস্তারিত খরচ বিভাজন না থাকায় এত বড় আকারের কলেবরের ব্যয়ের যৌক্তিকতা-ন্যায্যতা নিরূপণ সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে কমিশন।
নির্মাণব্যয় উপখাতে ওনার ক্যাম্প স্থাপন খাতে ব্যয় ২৯ কোটি ৮৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেহেতু প্রকল্পটি ইআরএলের বর্তমান আঙিনায় হচ্ছে, এক্ষেত্রে অর্থের অপচয় কমাতে বলেছে কমিশন। প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন ব্যয় উপখাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৯ কোটি ২৬ লাখ ৯২ হাজার টাকা, যা অত্যাধিক বলে মতামত তুলে ধরেছে কমিশন।
প্রকল্পে টেলিযোগাযোগ, ইন্সট্রুমেন্টেশন ও কন্ট্রোল সিস্টেম সরঞ্জাম খাতে ৮৩১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এছাড়া ‘বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি খাতে ৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এসব ব্যয়কে অত্যাধিক বলে দাবি করেছে কমিশন।
প্রশাসনিক, আবাসিক ও অন্যান্য ভবন এলাকার জন্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি খাতেও ১৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্য়য় প্রাক্কলন করা হয়েছে। যা অত্যাধিক বলে প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। কমিশন বলছে, এ ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমিয়ে পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে সভায় আলোচনা হতে পারে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে ব্যাংক চার্জ বাবদ ৪৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ধরে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা মোট ব্যয়ের ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এ ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বৈদেশিক প্রশিক্ষণের বিষয়ে যেহেতু বর্তমানে অর্থ বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, সেহেতু প্রকল্পে ১৮৪ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি যৌক্তিকপর্যায়ে কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে কমিশন।
তাছাড়া বৈদেশিক প্রশিক্ষণ ৩০ কোটি টাকা ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণে জনবল পাঠানোর খরচ বাবদ পৃথকভাবে সাত কোটি ৬৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
প্রকল্পে ‘কিক অব মিটিং’ ও অন্যান্য সভায় অংশগ্রহণের জন্য ঠিকাদারের অফিসে যাতায়াত, ভেন্ডরের কারখানা ইন্সপেকশন ব্যয় উপখাতে ১৬টি মিটিংয়ের জন্য এক হাজার ৯৫ জনকে (দিন হারে) মোট চার কোটি ৪৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্রতিটি মিটিংয়ের জন্য দিন সংখ্যা এবং মিটিংয়ের ধাপ যৌক্তিকপর্যায়ে কমিয়ে আনার পরামর্শও দিয়েছে কমিশন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে রিফাইনারি দরকার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এমন প্রকল্প নেওয়া ঠিক হবে না বলে মত দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া রিফাইনারি ব্যবসা কঠিন বলেও মনে করছেন তারা।
ড. ইজাজ হোসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক। তিনি জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে রিফাইনারি থাকলে বেটার (খুব ভালো) হবে। ডিজেলের চাহিদাপূরণ করা যাবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন ব্যয়ের প্রকল্প নেওয়া ঠিক হবে না। তবে এটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
রিফাইনারি ব্যবসা সহজ নয় উল্লেখ করে বুয়েটের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, এটা অনেক কঠিন। রিফাইনারি থেকে গ্যাসোলিন পাবো, সেই হিসেবে কিন্তু আমাদের গ্যাসোলিনের চাহিদা নেই। এটা একটা টেকনিক্যাল বিষয়। তাহলে রিফাইনারি থেকে যে গ্যাসোলিন পাবো, তা কী করবো? আবারো বলছি, রিফাইনারি ব্যবসা কঠিন। প্রকল্প সাবধানে নেওয়া দরকার। যেটা ব্যবহার হবে না, সেটা কী করবো তারও হিসেব কষা দরকার।