'সম্ভব না' থেকে অপার সম্ভাবনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
২৪ জুন, ২০২২, 2:04 PM

নিজস্ব প্রতিবেদক
২৪ জুন, ২০২২, 2:04 PM

'সম্ভব না' থেকে অপার সম্ভাবনা
একে তো বৈরী নদী, তার ওপর টাকার টানাটানি। প্রশ্ন ছিল, কীভাবে নির্মাণ হবে পদ্মা সেতু? জবাব ছিল, সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। শত বাধা পেরিয়ে অসম্ভবকে জয় করে সেই 'সম্ভব না' শব্দগুচ্ছকে হারিয়ে প্রমত্ত পদ্মার ওপর নির্মিত হয়েছে অপার সম্ভাবনার সেতু।
পানিপ্রবাহে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী পদ্মা। পদ্মায় গত দুই যুগে যত পানি গড়িয়েছে, সেতু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক তার চেয়ে কম হয়নি। রাজনীতিতে বারবার ঝড় তুলেছে। সব ঝড়ঝাপ্টা জয় করে খরস্রোতা পদ্মায় বাংলাদেশের সক্ষমতা ও গর্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে এ সেতু।
সবচেয়ে বড় সংশয় ছিল, এত বড় সেতু বাংলাদেশ নির্মাণ করতে পারবে কিনা। যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে হালের লেবুখালীর পায়রা সেতু- সব বড় অবকাঠামো নির্মাণে ছিল বিদেশি ঋণ, অনুদান এবং পরামর্শ। ঋণের শর্ত মেনে বিদেশি প্রকৌশলী ও পরামর্শকদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে এসব সেতু।
টাকার চাপ মোকাবিলা :সেতু বিভাগ বলছে, পদ্মায় সেতু নির্মাণে ১৩টি চ্যালেঞ্জ ছিল। তাদের মতে সবচেয়ে বড় চাপ ছিল, অর্থায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার জোগান। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ঠিক রাখা ছিল বিশাল চাপ। এ কারণেই মনে করা হয়েছিল নিজের টাকায় সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার জোগান ঠিক রাখা সবচেয়ে বড় চাপ ছিল। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ সহায়তার কারণে কখনোই সংকটে পড়তে হয়নি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের যাত্রা হয়েছিল মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলন করে। প্রকল্পের অনুমোদনের সময়ও ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। সেই টাকা জোগাড়েই দাতাদের কাছে ঋণ চাইতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজ টাকায় এর তিনগুণ ব্যয়ে সেতু নির্মাণ করে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশ।
এত ব্যয়ে সেতু নির্মাণের সমালোচনা ছিল। একে বিলাসী প্রকল্পও বলা হচ্ছিল। তবে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে প্রতিদিন ৪১ হাজার ৫৫০টি যানবাহন পদ্মা সেতু পারাপার হবে। সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ১৮ বছরেই যানবাহনের টোল থেকে উঠে আসবে পদ্মা সেতুর সমুদয় নির্মাণ ব্যয়। ৩৫ বছরে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি আসবে টোল থেকে। ফলে পদ্মা সেতু নির্মাণ লাভজনক হবে দেশের জন্য।
আওয়ামী লীগকে দুর্নীতির এই অভিযোগে প্রবল চাপের মুখে পড়তে হয় রাজনীতিতে। তখনও অভিমত এসেছিল, পদ্মা সেতু আর হবে না। বিরোধী দল, বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের প্রবল সমালোচনায় তখন জেরবার ছিল সরকার। আবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৪ সালের মধ্যে সেতু নির্মাণেরও চাপ ছিল। এই উভয় সংকট কাটাতে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের চাপ নিতে হয়। শুরুতে এটা অসম্ভব মনে হলেও, ধীরে ধীরে স্বপ্নের সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়েছে। এ সেতু নির্মাণের জন্য প্রশংসা পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নদী ও কারিগরি চ্যালেঞ্জ :নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ নিলেও বড় বাধা ছিল পদ্মা নদী নিজেই। পদ্মাকে বশ মানিয়ে সেতু বানাতে প্রায় সাত বছর লেগেছে। কখনও তীব্র স্রোত, কখনও ভাঙনের মতো খামখেয়ালি বারবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এককভাবে এত বড় প্রকল্প নির্মাণের অভিজ্ঞতাই ছিল না বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখিয়েছিল পদ্মা সেতু নির্মাণে। কিন্তু পদ্মার উত্তাল রূপ দেখে এখানে সেতু নির্মাণ অসম্ভব মত দিয়ে চলে যায় তারা। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও আশঙ্কা করেছিলেন, পদ্মা সেতু হবে না।
কিন্তু বিদেশি পরামর্শকদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। নির্মাণকাজ শুরু হয় মাওয়া প্রান্তে ছয় নম্বর পিলারের পাইলিংয়ের মাধ্যমে।
বর্ষার তিন মাস বন্যায় আর শীতের দুই মাস ঘন কুয়াশায় পদ্মা সেতুর কাজ বারবার ব্যাহত হয়েছে। পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য পানিবিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, পদ্মায় বর্ষায় স্রোতের গতি সেকেন্ডে চার থেকে সাড়ে চার মিটার। স্রোতের তোড়ে ইস্পাতের শিকল ছিঁড়ে মাঝনদীতে সেতুর মালপত্রসহ রাখা বার্জ ভেসে গেছে। থরথর করে কাঁপত বার্জ।
করোনা মহামারির কারণে বিদেশ থেকে মালপত্র আনা এবং বিদেশি জনবলের আসা-যাওয়া মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে আকস্মিক ভাঙনে সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড সংশ্নিষ্ট এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ১২৬টি রোডওয়ে ডেক স্ল্যাব এবং ১৯২টি রেলওয়ে স্ট্রিঞ্জারসহ কয়েক কোটি টাকার মালপত্র নদীতে চলে যায়।
প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা জানান, চোখের পলকে মালপত্র টেনে নিয়ে যায় পদ্মা নদী। মালপত্র উদ্ধারে ক্রেন দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল; বরং ক্রেন বাঁচাতে মালপত্র বাঁচানোর আশা বাদ দেওয়া হয়। এমন দানবীয় নদীর সঙ্গে লড়াই করে নির্মিত পদ্মা সেতু অসম্ভব জয় করার এক রূপকথা।