রাত্রি কথন : সাংবাদিক সোনিয়া হক
ডেস্ক রিপোর্ট
০২ জুলাই, ২০২২, 5:25 PM
ডেস্ক রিপোর্ট
০২ জুলাই, ২০২২, 5:25 PM
রাত্রি কথন : সাংবাদিক সোনিয়া হক
রাত যতো গভীর হয়, দশতলায় তের'শ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের ছোট্ট এই বারান্দা টা আমার ততো বেশি আপন হয়ে উঠে। দেয়াল ঘড়ির কাঁটা টা রাত বারোটার ঘর পেরিয়েছে বহুক্ষণ আগে। এদিকে,আরো একটা নির্ঘুম রাতের প্রস্তুতি চলছে আমার। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চোখে পড়লো চারদিকে সুউচ্চ অট্টালিকার মাঝখানে অনেকখানি চেপ্টে যাওয়া চালা টার দিকে, খুব শহুরে সভ্য ভাষায় আমরা যাকে বস্তি বলি। বলে রাখা ভালো জায়গাটার সুন্দর একখানা নাম মডার্ন রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার খাতিরে দিলেও,আমার একে ' নূরের চালা' বলতেই বেশি অভিজাত মনে হয়। তো সেই নূরের চালায় রাত গভীর হয়েছে। ভেতর টা কেমন কালো হয়ে আছে।
দশতলার ওপরে হওয়ায়,এখান থেকে ঘরগুলোকে খেলার ঘর আর এর ভেতরের মানুষগুলোকে পুতুলের মতো লাগে। মজার ব্যপার হলো চালার ভেতরের আলো যতো কমে, আশপাশের বহুতল ভবন গুলোতে আলো পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। সেখানে সবে সন্ধ্যে হলো আর কি!
রাস্তায় দু'একটা রিকশার টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। ঘড়ির কাঁটার টক টকানি জানিয়ে দিলো সে থেমে নেই। রাত চারটা দশ, মসজিদে আজান শোনা গেলো, রাস্তায় দুএকজন মুসল্লীর পায়ের আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে।
পিনপতন নীরবতা ভেঙে চালার ভেতরে মনুষ্য চলাচল সক্রিয় হয়ে উঠলো। আমি নড়েচড়ে বসলাম। কম পাওয়ারের আলোয় এতোদূর থেকে স্পষ্ট না দেখা গেলেও বোঝা যাচ্ছে, বাথরুমের সামনে দীর্ঘ জনজট। কেউ একজন ডিপটিউবয়েলটা চেপে যাচ্ছে, ঘটাং ঘটাং শব্দ। একটাই বোধহয় রান্নাঘর, সেখানেও লাইন লেগে গেছে। দিনের বেলাতেও প্রায়ই এখানে জটলা দেখা যায় নারীদের, বাটনা বাটা,কোটনা কাটা, রেল লাইন বানিয়ে উকুন বাছা সবই চলে এখানে। মাঝেমধ্যে চুলোচুলি,বোটাবটিও চলে দু-তিন ঘরে । সে সব কেইসে পুলিশও আসে। আবার কিছুদিন চুপচাপ।
এরইমাঝে মসজিদ থেকে মুসল্লিরা নামাজ শেষে ঘরে ফেরা শুরু করেছে। বস্তির ঠিক সামনে চায়ের দোকানটার সাটার উঠলো কেবল। কড়াই-খুন্তির জম্পেশ মেলবন্ধনে নূরের চালা বস্তিতে আরো একটা নতুন দিনের সূচনা হরে গেলো,ওদের এ আনন্দে আমার ভেতর কি এক উত্তেজনা!এ যেনো কৈশোরে পড়া মাসুদ রানার থ্রিল,সব সময় কি একটা হয়,কি একটা হয় হয় ভাব।
যাই হোক বলছিলাম একটা নতুন দিনের কথা।একটা নতুন দিন,একটা নতুন তারিখ। যোগ হবে কিছু নতুন সম্ভাবনা, কিছু না-পাওয়া হয়তো নীরবেই হারিয়ে যাবে। কিছু নতুন স্মৃতি যোগ হবে,অন্যদিকে পুরনো কিছু স্মৃতিতে আরো একপস্তর ধুলো জমবে। কেউ কেউ হারিয়ে যাবে আজ, আবার অন্য কেউ এসে ঘর বাধবে হারিয়ে যাওয়া মানুষটার এক কামরার ঘরটায়। খালি থাকবে না কিছুই। যান্ত্রিক এই শহরে খালি থাকে না কিছুই।
দিনের কাজ শুরু করেছে নূরের চালার বাসিন্দারা। একে একে ছুটছে কর্মযজ্ঞে। মুটে,মজুর,গার্মেন্টসশ্রমিক,ফেরিয়ালা,রিকশায়ালা কে নাই এখানে!মহামারির সময় নিঃস্ব হওয়া অনেক মধ্যবিত্তকেও এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে।ছুটছে সববাই। টিকে থাকতে হলে আরেকটা দিন যে ছুঁতেই হবে, এই কঠিন জীবনবোধই হয়তো ওদের বাঁচিয়ে রাখে। সকালের সূর্যের আলোয় আশপাশের হাইরাইজ বিল্ডিং গুলোয় জ্বলতে থাকা নিয়ন বাতি গুলো মৃদু হেসে, হারিয়ে যায়। আমার বারান্দা থেকে শুধু সুর্যাস্তই দেখা যায়। দশতলার ওপরে থাকা আমার আমিটাকে বড্ড নিঃস্ব লাগে, দরিদ্র লাগে, ফাঁকা লাগে এই সময়টায়। কটকটে সূর্যের আলোয় আমার চোখ জ্বলে ওঠে। আরেকটা সূর্যাস্তের অপেক্ষা নিয়ে আমি ঘরে ফিরে আসি। চারদিকের দরজা-জানালা বন্ধ করে, পর্দা টেনে, আশ্রয় খুঁজি। আমার দুচোখ জুড়ে মরার ঘুম ভর করে। মাথার ভেতরে বাজতে থাকে টুংটাং, কাপড় কাচা,বাসন মাজার ,কল চাপার শব্দ......আমি তলিয়ে যাই গভীর ঘুমে.................