লাইনচ্যুত রেলওয়ের পিপিপি প্রকল্প
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ আগস্ট, ২০২৩, 5:52 PM
নিজস্ব প্রতিবেদক
১৭ আগস্ট, ২০২৩, 5:52 PM
লাইনচ্যুত রেলওয়ের পিপিপি প্রকল্প
সরকারি—বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সময় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ১২টি প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়ন পর্বে যেতে পারছে না বেশিরভাগ প্রকল্প। ফলে পরিকল্পনা অনুযায়ী, এগুলো থেকে যে সুফল পাওয়ার কথা, তা অধরাই থেকে যাচ্ছে। এর জন্য সঠিক উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রেলওয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাদের এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়া, যাত্রীসেবা বৃদ্ধি, রেলের রাজস্ব বৃদ্ধি, ঢাকার যানজট কমা ইত্যাদি সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি। প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগেরই বেসরকারি বিনিয়োগের অংশীদার মেলেনি। এ ছাড়া জমি হস্তান্তরে সমস্যার কারণেও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন পর্বে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পিপিপির আওতায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নেওয়া প্রকল্পগুলো হচ্ছে- জয়দেবপুরের ধীরাশ্রমে ইন্টারনাল কন্টেইনার ডিপো, ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার রেললাইন, চট্টগ্রাম হাসপাতাল, চট্টগ্রামে পাঁচ তারকা হোটেল, চট্টগ্রামে শপিংমল কাম—গেস্ট হাউস নির্মাণ, কমলাপুরে হাসপাতাল, সৈয়দপুরে হাসপাতাল, পাকশী হাসপাতাল, খুলনায় মেডিকেল কলেজ, শপিংমল কাম—গেস্ট হাউস, বিমানবন্দর মাল্টিমোডাল হাব ও কমলাপুর মাল্টিমোডাল হাব নির্মাণ।
প্রকল্প সূত্র জানায়, কমলাপুরের ডিপোটি গাজীপুরে সরিয়ে নেওয়া হলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল টঙ্গী, পুবাইল, আশুলিয়া, সাভার ইত্যাদি এলাকায় পরিবহন সহজ হবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম থেকে রেলপথের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন বাড়াতে ২০০৩ সালে ধীরাশ্রমে নতুন কন্টেইনার ডিপো নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। এরপর ২০০৪ সালের জুলাইয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৭ সালের জুনে সম্ভাব্যতার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
ঢাকা—চট্টগ্রাম—কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের আওতায় কারিগরি সহায়তা শীর্ষক প্রকল্পে ধীরাশ্রম আইসিডি নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং মূল নকশা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের দিকে এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশার কাজ শুরু করে সংশ্লিষ্ট কনসালটেন্টরা। ২০২২ সালের জুনে তারা সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
ইন্টারনাল কন্টেইনার ডিপো প্রকল্পটির এক কর্মকর্তা জানান, গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ২২২ একর জমিতে এই আইসিডি নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি কোন মডেলে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। প্রকল্পটির ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) এখনও অনুমোদন পায়নি। এর অর্থায়নের বিষয়টিও চূড়ান্ত হয়নি। আরব আমিরাত ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের এতে অর্থায়নের কথা থাকলেও তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। জানা মতে, তারা এখনও অর্থায়ন করতে চায়। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকও এ প্রকল্পে ঋণ দিতে চায়। তারা আইসিডির জমি অধিগ্রহণে ৩ হাজার ও নির্মাণে ৩ হাজার কোটি সহ মোট ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে। এখন আমরা চাচ্ছি পিপিপি মোডালিটিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করতে। তার অধীনে থাকা আরেকটি প্রকল্প রাজধানীর কমলাপুরে হাসপাতাল নির্মাণ। এটির অগ্রগতি হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ইউনাইটেড গ্রুপ এ হাসপাতালটি ৪০০ কোটি টাকায় নির্মাণ করবে। ৩০ বছর ব্যবহার করার পর তারা এর মালিকানা রেলওয়েকে হস্তান্তর করবে।
চট্টগ্রাম সিআরবি এলাকায় ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল এবং ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণে ২০২০ সালের ১৮ মার্চে চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী মোট ৬ একর জায়গার ওপর ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নিজস্ব অর্থায়নে হাসপাতালটি নির্মাণ করবে এবং ৫০ বছর পর সম্পূর্ণ হাসপাতাল রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করবে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ১৫ তলা একটি শপিংমল কাম—গেস্ট হাউস নির্মাণ করতে রেলওয়ে গত ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এপিক প্রোপার্টিজ কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী ৪০ বছর ব্যবহারের পর তারা এটি রেলওয়েকে হস্তান্তর করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের কারণে থেমে আছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের কাছে হোটেল নির্মাণ প্রকল্পটি একইভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। রেলওয়ের জমি একটি পক্ষ ব্যবহার করছে, তারা চায় না এটা হোক।’
এ ছাড়া ঢাকা মহানগরীর যানজট দূর করার জন্য ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের আগস্টে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে। এরপর ২০১৯ সালে একটি চীনা প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা নিয়ে সমীক্ষা চালায়। এর প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। রেলপথটি টঙ্গী থেকে গাবতলী হয়ে কামরাঙ্গীরচর, নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া পূর্বাচল সড়ক হয়ে পুনরায় টঙ্গীকে সংযুক্ত করবে। বৃত্তাকার এ রেলপথের ৭০ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার হবে উড়ালপথ আর বাকি ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার হবে মাটির নিচ দিয়ে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণের কাজ সরকারি—বেসরকারি অংশীদারিত্বে বাস্তবায়ন হবে। এর বাস্তবায়ন কাজ ২০২২ সালে শুরু হয়ে ২০২৮ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। দীর্ঘদিন কোনো বেসরকারি অংশীদার না মেলায় থমকে ছিল এর কাজ। এখন প্রকল্পটি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে কোরিয়া সরকার। কোরিয়া সরকারের সঙ্গে জি টু জি প্লাটফর্মে এটি বাস্তবায়ন হবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এর বাইরে সৈয়দপুরে ও পাকশীতে হাসপাতাল, খুলনায় মেডিকেল কলেজ ও শপিংমল কাম—গেস্ট হাউস, বিমানবন্দর মাল্টিমোডাল হাব ও কমলাপুর মাল্টিমোডাল হাব নির্মাণ প্রকল্পের কোনোটিরই অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
বাংলাদেশের রেলওয়ের মহাপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ‘প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দেরির জন্য আসলে কেউ দায়ী নয়। কারণ সরকারি—বেসরকারি মডেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন একটু সময়সাপেক্ষ। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে পিপিপি কর্তৃপক্ষ ট্রানজেকশনাল অ্যাডভাইজার নিয়োগ করে। তারা আবার বিভিন্ন চুক্তি ও দরপত্র দলিল প্রস্তুত করে। সবকিছু শেষ করতে একটু দেরি হয়।’